বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪, ০৫:১০ অপরাহ্ন

‘প্রতি বছর বন্যায় আমরা সর্বস্বান্ত হই। তবুও আশা ছাড়িনি। ভেবেছি কোনো একদিন হয়তো তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়ন হবে। এ আশায় থাকতে থাকতে আমরা আজ পথের ভিখারি।’

‘প্রতি বছর বন্যায় আমরা সর্বস্বান্ত হই। তবুও আশা ছাড়িনি। ভেবেছি কোনো একদিন হয়তো তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়ন হবে। এ আশায় থাকতে থাকতে আমরা আজ পথের ভিখারি।’

বুধবার (২২ মার্চ) সকালে তিস্তা নদীর চরে আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন ৮০ বছরের বৃদ্ধ প্রফুল্ল কুমার রায়। তিনি বলেন, ‘জমিজমা যতটুকু ছিল সব তিস্তার গর্ভে বিলীন হয়েছে। এভাবে আর কত দিন চেষ্টা করব? আমাদের সবকিছু কেড়ে নেবে এ তিস্তা। এখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গর্ত খুঁড়ে নিয়ে যাবে তিস্তার পানি। চাষাবাদ হারিয়ে আমরা হব নিঃস্ব।’

প্রফুল্ল কুমার রায়ের মতোই কৃষক সিরাজুল ইসলাম বলেন, প্রতি বছর এ বালুচরে মিষ্টিকুমড়ার আবাদ করি। অনেক কষ্টে মেশিনের মাধ্যমে গাছে পানি দিই। কিন্তু তিস্তায় যদি পানি না থাকে তখন এ মেশিন দিয়েও পানি তোলা সম্ভব না।

‘দহগ্রাম থেকে শুরু করে পুরো তিস্তা নদী এলাকায় প্রায় তিন কোটি মানুষের বসবাস। তারা সবাই কৃষিকাজ করে জীবন চালান। এখানকার মানুষের পড়াশোনা নেই কিন্তু ভালো ফলন ফলিয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। সরকার ইচ্ছা করলে ভারত সরকারের সঙ্গে দীর্ঘদিনের যে পানির সমস্যা, তার সমাধান করতে পারে। এটা করতে পারলে আমাদের মতো মানুষের দুঃখ-কষ্ট দূর হবে।’

তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণের ২৫ বছরে এ দুই জেলার প্রায় দুই লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমি তিস্তার গর্ভে বিলীন হয়েছে। অনাবাদি হয়েছে প্রায় এক লাখ হেক্টর আর বালুচরে পরিণত হয়েছে এক লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমি। গৃহহারা হয়েছে প্রায় ৬০ হাজার পরিবার

লালমনিরহাট জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, তিস্তা নদীতে পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম ইউনিয়ন, হাতীবান্ধা উপজেলার সানিয়াজান, সিঙ্গিমারী, গোড্ডিমারী, সিন্দুর্ণা, পাটিকাপাড়া, ডাউয়াবাড়ি ইউনিয়ন, কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, তুষভান্ডার, কাকিনা ইউনিয়ন, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়ন, লালমনিরহাট সদর উপজেলার গোকুণ্ডা, খুনিয়াগাছ ও রাজপুর ইউনিয়নে ছোট-বড় প্রায় ৪৬টি চর জেগে উঠেছে। এসব চরের মধ্যে ১৫টিতে মানুষের বসতি গড়ে উঠেছে।

কৃষক প্রফুল্ল কুমার রায়। ছবি : ঢাকা পোস্ট
অপরদিকে, ধরলা নদীতে লালমনিরহাট সদর উপজেলার মোগলহাট ও কুলাঘাটে পাঁচটি চর জেগে উঠেছে। এর মধ্যে দুটি চরে জনবসতি গড়ে উঠেছে। এছাড়া রত্নাই ও সানিয়াজান নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ায় এ দুই নদীর বুকে বোরো ধান চাষের ধুম পড়েছে। বোরো ধান চাষের ধুম পড়েছে ধরলা নদীর বুকেও। জানা গেছে, তিস্তার বুকে এ বছর প্রায় ১০ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ, রসুন, আলু, কুমড়াসহ সবুজ ফসল চাষ করেছেন কৃষকরা। যার বাজারমূল্য প্রায় ৩০০ কোটি টাকা।

দহগ্রাম থেকে শুরু করে পুরো তিস্তা নদী এলাকায় প্রায় তিন কোটি মানুষের বসবাস। তারা সবাই কৃষিকাজ করে জীবন চালান। এখানকার মানুষের পড়াশোনা নেই কিন্তু ভালো ফলন ফলিয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। সরকার ইচ্ছা করলে ভারত সরকারের সঙ্গে দীর্ঘদিনের যে পানির সমস্যা, তার সমাধান করতে পারে। এটা করতে পারলে আমাদের মতো মানুষের দুঃখ-কষ্ট দূর হবে
তিস্তাপাড়ের কৃষক সিরাজুল ইসলাম
তিস্তা ব্যারাজ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ৬১৫ মিটার দীর্ঘ এ ব্যারাজের ৫২টি গেটের মধ্যে ৪৪টি গেট তিস্তার মূল ধারা প্রবাহের এবং বাকি আটটি সেচ প্রকল্পের জন্য। সেচ প্রকল্প নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি সিলট্রাফ খনন করা হয়েছে। এ ব্যারাজের স্বাভাবিক পানির প্রবাহ ৫২ দশমিক ৪০ সেন্টিমিটার। স্বাভাবিক পানির প্রবাহ ২০ হাজার কিউসেক ধরা হলেও চার লাখ কিউসেক পানির ধারণক্ষমতা রয়েছে ব্যারাজে। এর চেয়ে অতিরিক্ত পানি বেড়ে গেলে ব্যারাজ রক্ষার জন্য লালমনিরহাট অংশে করা হয়েছে বাইপাস সড়ক। ৫২টি গেটের মধ্যে শুধু শুষ্ক মৌসুমে ব্যারাজের আটটি গেটের পানি সিলট্রাফ হয়ে সেচ ক্যানেল দিয়ে নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার কথা থাকলেও গত বছর প্রয়োজনীয় পানির অভাবে মাত্র আট হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া হয়।

হঠাৎ করে এ অঞ্চলের মানুষের কাছে একটি দুঃসংবাদ এসেছে। তিস্তা নদীতে যদি পানি না থাকে তবে এ অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হবে। তাই আশা করছি দ্রুত তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে। পাশাপাশি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ যে দুটি খাল খননের উদ্যোগ নিয়েছে তা বন্ধ করতে হবে
অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম, সভাপতি, তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ

অপরদিকে, বাকি ৪৪টি গেট দিয়ে বর্ষাকালের অতিরিক্ত পানি তিস্তার মূলধারায় প্রবাহিত হয়। ফলে বর্ষাকালে বন্যা আর শুষ্ক মৌসুমে মরুভূমিতে পরিণত হয় লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলার বৃহৎ অংশ। ব্যারাজ নির্মাণের সময় তিস্তা নদীর উভয় তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করে নির্দিষ্ট পথে তিস্তার মূলধারা প্রবাহের কথা থাকলেও অজ্ঞাত কারণে পূর্ব তীর (বাম তীর) অরক্ষিত থেকে যায়। ফলে বালু জমে তিস্তা নাব্যতা হারাচ্ছে। লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলার লোকালয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এর পানি। উভয় তীরের ব্যবধান হয়েছে প্রায় ১২-১৪ কিলোমিটার। এতে পূর্ব তীরের লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলার ২৬টি ইউনিয়নের বৃহৎ জনগোষ্ঠী বর্ষাকালে বন্যা, পানিবন্দি ও নদীভাঙন আর শুষ্ক মৌসুমে মরুভূমির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে মানবেতর জীবনযাপন করছে। পূর্ব তীর রক্ষা বাঁধ না থাকায় লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলার বৃহৎ জনগোষ্ঠী তিস্তা ব্যারাজের সুফলের পরিবর্তে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।

২০১১ সালে যখন পানিচুক্তি হওয়ার কথা ছিল তখন কথা উঠেছিল পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশকে পানি দিতে চান না। কিন্তু আমরা জেনেছি পশ্চিমবঙ্গ সরকার দক্ষিণ সরকারকে টাকা বরাদ্দ দিয়েছে,পরে চুক্তিটি হয়নি। কিন্তু ২০২৩ সালে দেখতে পেলাম সেখানে এক লাখ জমি চাষাবাদের জন্য খাল খনন করা হচ্ছে। যা হলে বাংলাদেশের অনেক বড় ক্ষতি হবে। এটি হতে দেওয়া যাবে না। এখনই বাংলাদেশ সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তা না হলে পুরো উত্তরাঞ্চলের মানুষ পানি সংকটে পড়বে
অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ, পরিচালক, রিভারাইন পিপল
তিস্তার পূর্ব তীর রক্ষা কমিটির তথ্য মতে, তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণের ২৫ বছরে এ দুই জেলার প্রায় দুই লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমি তিস্তার গর্ভে বিলীন হয়েছে। অনাবাদি হয়েছে প্রায় এক লাখ হেক্টর আর বালুচরে পরিণত হয়েছে এক লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমি। গৃহহারা হয়েছে প্রায় ৬০ হাজার পরিবার।

নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘পার্শ্ববর্তী দেশের যেন কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে লক্ষ রেখে ভারতের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা উচিত। কিন্তু আমরা দেখেছি সেটি তারা করছে না। ১৯৯৭ সালে অনুষ্ঠিত সভায় আন্তর্জাতিক পানির প্রবাহ কনভেনশন গ্রহণ করা হয়। কনভেনশনের শর্ত ছিল, ৩৫টি দেশ কনভেনশনের প্রতি সমর্থন করলে তা আইনে পরিণত হবে। কিন্তু ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার করায় বাংলাদেশে অনেক সংকট তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের ১১৫ কিলোমিটার যে নদী রয়েছে তা মরতে বসেছে। তিস্তায় যে সেচ প্রকল্প রয়েছে সেটি কোনো কাজে আসছে না। বলা যায় উত্তর অঞ্চলের মানুষের জীবন বিপন্নপ্রায়। উত্তরাঞ্চলের যে ক্ষতি হয়েছে তার দায়-দায়িত্ব ভারতকে নিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, ২০১১ সালে যখন পানিচুক্তি হওয়ার কথা ছিল তখন কথা উঠেছিল পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশকে পানি দিতে চান না। কিন্তু আমরা জেনেছি পশ্চিমবঙ্গ সরকার দক্ষিণ সরকারকে টাকা বরাদ্দ দিয়েছে,পরে চুক্তিটি হয়নি। কিন্তু ২০২৩ সালে দেখতে পেলাম সেখানে এক লাখ জমি চাষাবাদের জন্য খাল খনন করা হচ্ছে। যা হলে বাংলাদেশের অনেক বড় ক্ষতি হবে। এটি হতে দেওয়া যাবে না। এখনই বাংলাদেশ সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তা না হলে পুরো উত্তরাঞ্চলের মানুষ পানি সংকটে পড়বে।

তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এ অঞ্চলের মানুষ তিস্তা মহাপরিকল্পনার বিষয়ে দাবি জানিয়ে আসছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে চীন সরকার আন্তরিক। কয়েকবার রাষ্ট্রদূতসহ অনেকে তিস্তা ব্যারাজ পরিদর্শন করেছেন। তিস্তার চরাঞ্চলের মানুষরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। এবার হয়তো তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে। কিন্তু হঠাৎ করে এ অঞ্চলের মানুষের কাছে একটি দুঃসংবাদ এসেছে। তিস্তা নদীতে যদি পানি না থাকে তবে এ অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হবে। তাই আশা করছি দ্রুত তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে। পাশাপাশি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ যে দুটি খাল খননের উদ্যোগ নিয়েছে তা বন্ধ করতে হবে।

লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, এখন পর্যন্ত তিস্তায় এক হাজার কিউসেক পানি রয়েছে। যা দিয়ে কোনো কাজে আসছে না। পানি কম থাকায় নিয়ম অনুযায়ী মূল স্রোতধারার সব জলকপাট বন্ধ রয়েছে। ফলে পানিশূন্য রয়েছে মূল নদী।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved © 2023 ajkerpujibazar.com
Design & Developed by BD IT HOST